ফেসবুকে মাঝে মাঝে কিছু বিষয় চোখে আসে যা দেখলে হতাশ হই, মেজাজও খারাপ হয় প্রচন্ড। তেমনই একধরনের পোস্ট হচ্ছে কিছু ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলদের হিটলার বন্দনা।
একটু ব্যাকগ্রাউন্ড দেই।
আমাদের জেনারেশন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ দেখেনি। হিটলারের নৃশংসতার ব্যাপারে যা জানা সবই বইপত্র, সিনেমা বা ইন্টারনেট ঘাটাঘাটি করে। বাংলাদেশে হলোকাস্ট সার্ভাইভার কেউ নেই। আমেরিকা বা ইউরোপে এখনও বহু লোক জীবিত আছেন যারা নাৎজি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প থেকে বেঁচে ফিরেছেন।
এখন বুদ্ধিমান মানুষ মাত্রই বুঝতে পারে আপনি যতই পড়েন না কেন, বাস্তবতা কয়েকগুন ভয়ংকর হয়ে থাকে। বইয়ে ছয় মিলিওন মানুষ হত্যা কেবলই একটি সংখ্যা, অথচ সেই সময়ের মানুষেরা জানেন ছয় মিলিওন সংখ্যাটা কত ভয়ংকর! এই যে গত কয়েক মাস ধরে ইজরায়েল নৃশংসতার সাথে ফিলিস্তিনিদের হত্যা করছে, যে হত্যা যজ্ঞের খবর পড়ে আমেরিকার বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চরম মেধাবী ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকগণ ভিন্ন জাতির স্বার্থে নিজের দেশের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেছে - সেই ভিক্টিম সংখ্যা এখনও এক লাখও ছোঁয় নি। তাহলেই বুঝুন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধজুড়ে হিটলার কি নারকীয় হত্যাকান্ডই না চালিয়েছে!
এখন ইজরায়েলের হত্যাকাণ্ডে গোটা বিশ্বই ক্রোধে ফুঁসছে। ওদের ভিকটিম যেহেতু ফিলিস্তিনি মুসলিমরা, ওদের মিশন যেহেতু আল আকসা মসজিদকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া, ওরা যেহেতু জাতিতে ইহুদি, স্বাভাবিক কারণেই মুসলিমদের রাগ আরও বেশি। আল আকসা মসজিদ কোন পাড়া মহল্লার জামে মসজিদ না যে মসজিদ কমিটির চেয়ারম্যানের সাথে সভাপতির বিরোধের জেরে গঠিত হয়েছে। ইসলামের তিনটি মহাপবিত্রতম মসজিদের একটি হচ্ছে মসজিদে আকসা। কাবা ঘরের আগে মুসলিমরা আকসার দিকে ফিরেই নামাজ আদায় করতো। ইসলাম ধর্মে আল আকসার মর্যাদাই অনন্য।
আমরা জানি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এই হিটলারই ইহুদিদের যম ছিল। টোটাল সাইকোপ্যাথ। একটি হচ্ছে গুলি করে খুন করে ফেলা। আরেকটা হচ্ছে কষ্ট দিয়ে মারা এবং সেই কষ্ট দেখে পুলকিত বোধ করা। নাৎজি বাহিনী ছিল দ্বিতীয় দলের। ওদের নৃশংসতার নজির মানব ইতিহাসে খুব বেশি নেই।
এখন সমস্যা হচ্ছে, আবেগের চোটে বাঙ্গু পাবলিক হিটলারকে সাপোর্ট করে। "আজকের দিনে হিটলারের মতন নেতার বড্ড প্রয়োজন ছিল" ধরনের মন্তব্য করে। এই মূর্খের দল এইটা বুঝে না যে হিটলার ইহুদিদের যম হলেও মুসলিমদের জামাই আদর করে মিষ্টি খাওয়ানোর প্ল্যানও ওর মাথায় ছিল না। একটু পড়েন, তাহলেই জানবেন হিটলার নাৎজি জার্মানদের শ্রেষ্ঠ জাতি মনে করতো, এবং বাকি সব জাতিকে নিচু চোখে দেখতো। এই বিশ্বাসে সে এতটাই কট্টর ছিল যে যদি ওর এলাকায় কোন জার্মান ভিন্নজাতির কাউকে বিয়ে করতে চাইতো, ওকেও নাৎজি রক্ত মিক্সিংয়ের অপরাধে হত্যা করা হতো। দুই ভিন্ন জাতের বাবা মায়ের মিক্সড জার্মান সন্তানদেরও হিটলার মেরে ফেলেছে। "আরিয়ান রক্তের বিশুদ্ধতা" ওর কাছে মানুষের জীবনের চাইতেও বেশি মূল্যবান ছিল।
ইহুদিদের ভাগ্য খারাপ, হাতের কাছে ওদের পেয়েছে বলেই ওদের উপর দিয়ে প্রথম ঝড় গিয়েছে। বাই এনি চান্স যদি মুসলিমদের পেত, তাহলে আমাদেরও একই হাল করে ছাড়তো। "স্যামাইট" (বাইবেল অনুযায়ী নূহ নবীর (আঃ) পুত্র স্যামের বংশধর) হবার কারনে ইহুদিদের উপর যে অত্যাচার করেছে, আরবরাও কিন্তু জাতে "স্যামাইট।" ইহুদিদের নিশ্চিহ্ন করে নিশ্চিত থাকুন, প্রথমেই আমাদের মুসলিমদের দিয়ে সে গ্যাস চেম্বার ভরে ফেলতো। ইসলাম ঘোষণা করে প্রতিটা মানুষ সমান, কেউ কারোর চেয়ে বড় বা ছোট না, সাদা কালোতে কোন পার্থক্য নেই, বাদশা ফকিরে এক মসজিদে এক কাতারে দাঁড়িয়ে ইমামের পিছনে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করে, এক সাথে সিজদাহ দেয়। ইসলাম ঘোষণা করে নিজের জাত, রক্ত, গাত্রবর্ণ, টাকা অর্থবিত্ত ইত্যাদি নিয়ে অহংকার করার মানেই আপনি সরাসরি জাহান্নামী, কোন কথা ছাড়াই। এইগুলি নাৎজি আইডিওলজির সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক। কাজেই, হিটলার যে আমাদের নিশ্চিহ্ন করতে উঠে পড়ে লাগতো, এই ব্যাপারে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই।
কিন্তু ছাগলদের পরিচয়ইতো ছাগ্লামীতে। নাহলে প্রমান হবে কিভাবে যে ওরা ছাগল? তাই ম্যা ম্যা করে হিটলারের সমর্থন করবেই।
এই কারণেই আমি বলি, পড়ালেখার বিকল্প নাই। আজকাল লোকজন হাহাকার করছে, অমুক ইউটিউবার তমুক গাড়ি কিনে ফেলছে, আর আমরা পড়াশোনা করে কি ঘোড়ার আন্ডা পয়দা করছি? আপনি তাহলে পড়ালেখার মূল্যই বুঝেন নাই। আপনি লোভী, টাকা কামানোর জন্য পড়াশোনা করেছেন। পড়ালেখার আসল উদ্দেশ্যই হচ্ছে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা। সব ধরনের বই পড়বেন, মন মানসিকতার বিকাশ ঘটাবেন। একটা পর্যায়ে ন্যায়কে ন্যায়, অন্যায়কে অন্যায় বলতে শিখবেন। এই যে আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা ছাত্রত্ব হারাচ্ছে (এইসব ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হতে যদি কাউকে খুন করতে বলে, অনেকে খুন করতেও রাজি হবে), জেলে যাচ্ছে (আমেরিকায় জেলে যাওয়া মানে বিরাট দিগদারি, রেকর্ডে থেকে যায়, সহজে ভাল চাকরি পাওয়া যায় না), নিজের দেশ, জাতি, ধর্মের বিরুদ্ধে গিয়েও ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াচ্ছে - একেই বলে "শিক্ষা।" ওদের পড়ালেখা সফল। ওরাই এক সময়ে আমেরিকার নীতি নির্ধারক হবে। ওরাই বিশ্বের নেতৃত্ব দিবে। এই ভয়েই ইজরায়েল কাঁপছে। কারন ওরা বুঝে গেছে, ওদের ভবিষ্যত অন্ধকার! ভিক্টিম কার্ড প্লে করার দিন শেষ।
আর অন্যদিকে আমাদের পোলাপানরা হেলমেট মাথায় দিয়ে লাঠি হাতে নেমে স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের উপর চড়াও হয়, কারন ওরা কেবল নিরাপদ সড়ক চেয়েছিল!
দুই দেশের পড়ালেখার পার্থক্য এখন বুঝেছেন?
এখন আসি ইসলামের দৃষ্টিতে মূল পয়েন্টে।
আল্লাহ কুরআনে বলেছেন, ন্যায়ের জন্য নিজের বিরুদ্ধে হলেও যেতে। যদি নিজে অন্যায় করে থাকি, তবে আমাকে প্রথমে ভাবতে হবে আল্লাহর শাস্তির কথা। আমাকে স্বীকার করে ফেলতে হবে "হ্যা, কাজটা আমি করেছি। অন্যায় হয়েছে। আমি অনুতপ্ত। ক্ষমা প্রার্থী। শাস্তি দিতে চাইলে দিন, ক্ষমা করে দিলে কৃতার্থ থাকবো।"
যদি আমার বাবা, মা, স্ত্রী, সন্তান অন্যায় করে থাকে, তাহলেও আমাকে প্রথমে চিন্তা করতে হবে আল্লাহর কথা, এবং সাথে সাথে বলতে হবে, "হ্যা, কাজটা তোমরা অন্যায় করেছো। আল্লাহকে ভয় করো। উনার কাছে ক্ষমা চাও। এবং এর দন্ড ভোগ করো।"
যদি অন্যায়কারী গরিব হয়ে থাকে, তাহলেও বলতে হবে, "তুমি গরিব এইটা মানি, কিন্তু তোমার কোন অধিকার নেই এইভাবে ছিনতাই/দুর্নীতি করে অন্যের হক নষ্ট করার। তোমাকে দন্ড পেতে হবে।"
যদি অন্যায়কারী ধনী হয়ে থাকে, তাহলেও বলতে হবে, "আপনি পয়সা দিয়ে সব কিনে নিতে পারলেও অন্যায়কে চেপে যেতে পারবেন না। আপনি জুলুম করেছেন, আপনার শাস্তি প্রাপ্য।"
মজলুম যদি আমার চিরশত্রুও হয়, তারপরেও আমাকে জালিমের বিরুদ্ধেই অবস্থান নিতে হবে। আমার চিরশত্রুর বাড়িতে ডাকাত পড়েছে, আমার চিরশত্রুর মেয়েকে কেউ ধর্ষণ করেছে, আমার চিরশত্রুর ছোট বাচ্চাকে কেউ খুন করেছে, আমি যদি এসবে খুশি হই, তাহলে আমি মুসলিমই না। চিরশত্রুকে ন্যায় পাইয়ে দেয়ার মানে এই না যে আমার প্রতি করা ওর অন্যায়কে ক্ষমা করে দেয়া বা শত্রুতা ভুলে যাওয়া। স্পেসিফিক কোন ঘটনার ন্যায় অন্যায় নিয়েই এই আলোচনা।
কাজেই, যেসব মুসলিম হিটলারের প্রেমে গদগদ, তাঁদের উচিত এই মুহূর্তে তওবা করে আল্লাহর কাছে মাফ চাওয়া। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করা যে সময় থাকতেই এমন জালিমের জুলুম থেকে আমাদের পূর্বপুরুষদের বাঁচিয়ে দিয়েছেন। দোয়া করা যাতে পৃথিবী আর কখনই এমন নরপশুর দেখা না পায়। এবং দোয়া করা, আধুনিক নরপশু, নেতানিয়াহু ও এর সাগরেদরাও যেন ধ্বংস হয়।
ধর্মে, পার্সোনালিটিতে কন্সিস্টেন্ট হন। নাহলে ইহকাল, পরকাল সব শেষ।